অমিত সম্ভাবনাময় এক ক্রিকেটারের নাম লিটন কুমার দাস। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাকে ঘিরে প্রত্যাশার পারদ যেভাবে তুঙ্গে উঠেছিল তার ছাপ তিনি কতটা মাঠের ক্রিকেটে রাখতে পেরেছেন সে বিষয়ে অবশ্য অনেক প্রশ্ন আছে। তবে সম্প্রতি লিটনের ব্যাটিং
যেন একটু বেশিই মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। লিটনের ব্যাটিং সবসময়ই চোখের শান্তি। ছবিঃ গেটি ইমেজস লিটনের ব্যাটিং সবসময়ই চোখের জন্য শান্তি।দৃষ্টিনন্দন সব শটে বোলারদের পিটিয়ে তুলোধুনো করতে তার জুড়ি মেলা ভার।দারুণ সব পুল, হুক, ড্রাইভে নিমিষেই মুগ্ধ করে
দিতেন পারেন দর্শকদের।লিটনের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকও সম্ভবত এটিই- দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং। চলতি বছরে প্রায় নিয়মিতই এমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের দেখা মিলছে লিটনের কাছ থেকে, দর্শক-ভক্তরাও তাই মজেছেন লিটনে। তবে লিটনের এমন ভয়ংকর সুন্দর
ব্যাটিং দেখার সৌভাগ্য সবসময় হয়ে ওঠে না। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ধারাবাহিকতার বড্ড অভাব দেখা গেছে লিটনের ব্যাটিংয়ে। কালেভদ্রে ২-১টা দারুণ ইনিংস দেখে যেই না আশার বেলুন ফুলাতে শুরু করেন সবাই ঠিক তারপরই যেন আবারও ছন্দপতন। লিটনকে
ঘিরে সবার আক্ষেপও তাই বাড়ছিল। এত প্রতিভাধারী ব্যাটারের এমন পারফরম্যান্স তো হতাশ করারই কথা।
ধীরে ধীরে ধারাবাহিক হয়ে উঠছেন লিটন। বিশেষ করে ২০২১ সাল জুড়ে লিটনের পারফরম্যান্স ছিল একদমই যাচ্ছেতাই। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি কোথাও
রান পাচ্ছিলেন না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও একদম ভয়াবহ ছিল তার ফর্ম। লিটনের প্রতিভার ওপর ভরসা করে একের পর এক সুযোগ দিয়েই যাচ্ছিল টিম ম্যানেজমেন্ট, আর সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারছিলেন না লিটন। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও চরম
ব্যর্থ ছিলেন তিনি। সেই ব্যর্থতার দায়ে বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর টি-টোয়েন্টি দল থেকেও ছেঁটে ফেলা হয় তাকে। তবে বিশ্বকাপ পরবর্তী পাকিস্তান সিরিজের টেস্ট দলে সুযোগ পেয়েছিলেন লিটন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেকে দারুণভাবে মেলেও ধরেছিল তিনি। বিশেষ করে
প্রথম টেস্টে লিটনের অনবদ্য ব্যাটিং দেখেছে সবাই। যদিও ম্যাচ জেতাতে পারেননি দলকে, তবে ১ সেঞ্চুরি এবং ১ ফিফটিতে নিঃসন্দেহে নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই টেস্ট সিরিজ থেকেই যেন শুরু হলো লিটনের ঘুরে
দাঁড়ানো। টেস্টের ভালো পারফরম্যান্স এবং লিটনের প্রতিভায় নির্বাচকদের অগাধ আস্থার কারণে পরের সিরিজগুলোতে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতেও সুযোগ মিললো লিটনের। এবার আর নিরাশ করেননি তিনি। ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করলেন যেন।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেও দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন তিনি, পেয়েছিলেন ১টি সেঞ্চুরিও। এরপর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠেও দারুণ খেললেন লিটন। কিন্তু এবার আর সাদা পোশাকে নয়, নিজের চরম অস্বস্তির রঙিন পোশাকেই আলো
ছড়াতে শুরু করলেন তিনি। তুলে নিতে থাকলেন একের পর এক ফিফটি, সেঞ্চুরি সবকিছু। দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে সফরের পর সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও লিটনের দুর্দান্ত ব্যাটিং দেখলো ক্রিকেটবিশ্ব। দলকে ম্যাচও জেতাতে শুরু করলেন নিয়মিতভাবে। একসময়ের
সেই চরম অধারাবাহিক লিটনের ব্যাটেই রানের ফুলঝুরি ছুটতে শুরু করলো ধারাবাহিকভাবে। একসময় প্রচন্ড সমালোচনার শিকার হওয়া সেই লিটনকে নিয়েই প্রশংসার মহাকাব্য রচনা করতে থাকলেন ভক্ত-সমর্থকরা। নিজের প্রতিভার ছাপটা অবশেষে নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই
রাখতে শুরু করলেন লিটন কুমার দাস। পরিসংখ্যানে চোখ বোলালেও লিটনের উত্থানটা স্পষ্ট হবে।২০২১ সালের শুরু থেকে সে বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় পর্যন্ত সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ২৭ ইনিংস ব্যাট করে মোটে ৪৬৪ রান করেছিলেন লিটন।গড় মাত্র ১৭.১৯, একটি
সেঞ্চুরি যাও পেয়েছেন সেটাও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।সেটি বাদে আর কোনো পঞ্চাশ ছাড়ানো ইনিংসও ছিল না লিটনের ঝুলিতে।তবে একই সময়ে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে টেস্ট ক্রিকেটের বেলায়।টেস্টে ৮ ইনিংস ব্যাট করে ৩৭০ রান করেছিলেন লিটন, ৪৬.২৫ এর গড়টাও দুর্দান্ত।
ফিফটি ৪টি, যার মধ্যে একটিতে আবার খেলেছেন ৯৫ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস।সাদা পোশাকের লিটন তাই বরাবরই দারুণ। এবার গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরের সময়ে নজর দেওয়া যাক।সকল ফরম্যাট মিলিয়ে গত বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এখন
পর্যন্ত ৪৭ ইনিংসে ব্যাট করে ১৯২৭ রান করেছেন লিটন, গড়টাও নজরকাড়া, ৪২.৮২! ৪টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি ফিফটি করেছেন ১৩টি। ক্যারিয়ারসেরা ১৪১ রানের অনবদ্য ইনিংসটিও এসেছে এই সময়েই। উক্ত সময়ে লিটনের চেয়ে বেশি রান করতে পেরেছেন কেবল বাবর আজম।
লিটন যে ক্যারিয়ারের সেরা ফর্মে আছেন তা বোধ হয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না! সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের একটি ম্যাচের কথা আলাদা করে বলতেই হচ্ছে। সুপার টুয়েলভে ভারতের বিপক্ষে মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ১৮৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে টাইগাররা।
ইনিংসের শুরুতেই দলকে বিস্ফোরক সূচনা এনে দেন লিটন। তার এমন মারমুখি ব্যাটিংয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন ভারতীয় বোলাররা। একের পর এক চমৎকার সব শটে বোলারদের পিটিয়ে তুলোধুনো করছিলেন লিটন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটারের এরকম
দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং শেষ কবে আপনি দেখেছেন তা মনে করতে অনেক কষ্ট করতে হবে। লিটনের এমন বেধড়ক পিটুনিতে ম্যাচ জয়ের স্বপ্নও দেখতে থাকে টাইগাররা।৭ ওভারে ৬৬ রান তোলার পরই নামে বেরসিক বৃষ্টি, আর সেই বৃষ্টিই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের জন্য।
বৃষ্টির পরই ছন্দপতন হয় টাইগারদের। রানআউট হয়ে সাজঘরে ফিরে যান লিটন। বাংলাদেশও ম্যাচটা হেরে যায় ৫ রানে। তবে ২৭ বলে ৬০ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলা লিটনের এমন ভয়ংকর সুন্দর ব্যাটিং ভক্তদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে অনেকদিন।
একসময়ের তুমুল সমালোচিত লিটন কুমার দাস যেন সকল সমালোচনার জবাব দিয়ে যাচ্ছেন মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে। নিজের সেরা পারফরম্যান্স দিয়ে ভক্তদের চক্ষুশূল থেকে হয়ে উঠছেন সকলের প্রিয়মুখ। লিটনের এমন ভয়ংকর সুন্দর ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী দীর্ঘায়িত হতে থাকুক। আগুনে ফর্মের এমন লিটনকে দেখার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষায় ছিল সবাই!