মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩, ১১:৩৫ অপরাহ্ন

টুনটুনির বাসা || আল আমিন মুহাম্মাদ

টুনটুনির বাসা || আল আমিন মুহাম্মাদ / ৫ বার
আপডেট : সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২১
টুনটুনির_বাসা_||_আল_আমিন_মুহাম্মাদ
ছবি: সংগৃহীত

দেখতে দেখতে একদিন চোখে পড়লো, একটি বেগুন গাছে টুনটুনি বাসা বেঁধেছে। তালিব দেখে তো খুব খুশি! আর অবাক হলো- মাত্র দু-তিনটি পাতার সমন্বয়ে খড়কুটোর সুঁতো দিয়ে গেঁথেছে কি সুন্দর আবাস! বৃষ্টি হলেও পানি পড়বে না ভিতরে। কী সুন্দর কারুকাজ!

টুনটুনির বাসা || আল আমিন মুহাম্মাদ। তালিবদের বাড়ির কাছেই সবুজ-শ্যামল বিস্তৃত সোনালি মাঠ। আর বাড়ির সাথেই লাগা তাদের নিজস্ব একটি সবজির খেত। সারিসারি লাইন দিয়ে সাজানো বেগুন গাছ। বাবুইপাখির বাসার মত ঝুলে আছে বেগুনগুলো। দেখলে সত্যিই মন ভরে যায়! দু-তিন দিন পরপরই বড়-বড় বেগুনগুলো ছিঁড়ে গ্রামের হাটে নিয়ে যায় বিক্রি করতে তালিবের বাবা। সেও বাপের সাথে হাটে যায়।

বেগুনের খেত তো, তাই একটু বেশিই যত্ন নিতে হয় খেতের। এজন্য তালিবও তার বাপের সাথে মাঝেমাঝে কাজ করে। স্কুল ছুটির দিন সকাল ও বিকেল দুইবেলা আর অন্যান্য দিন বিকেলে কাজ করে। বিকেলে তার আব্বু কোন কোন দিন অল্প একটু কাজ করিয়ে তালিবকে বলে, যাও এবার খেলতে যাও। তালিব তো মহাখুশি হয় সেদিন। বাপের সাথে কাজ করতে সে যে একেবারেই অখুশি তা নয়। সে ইচ্ছে করেই বাপের সাথে ঘাস নিড়ায়, বেগুনে পোক লেগেছে কি না দেখে।

দেখতে দেখতে একদিন চোখে পড়লো, একটি বেগুন গাছে টুনটুনি বাসা বেঁধেছে। তালিব দেখে তো খুব খুশি! আর অবাক হলো- মাত্র দু-তিনটি পাতার সমন্বয়ে খড়কুটোর সুঁতো দিয়ে গেঁথেছে কি সুন্দর আবাস! বৃষ্টি হলেও পানি পড়বে না ভিতরে। কী সুন্দর কারুকাজ! আল্লাহ্ পাকের এসব কুদরত দেখে সে মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ আর ছুবহানাল্লাহ পড়লো কয়েকবার। তারপর, বাসার ভিতরে দেখতে পেলো, ছোট ছোট দুটো ডিম পেড়েছে টুনটুনিতে।

তালিবের মনটা আরও খুশিতে ভরে গেলো। খেতের পাশে আমগাছটায় দু’টো টুনটুনি খুব ডাকাডাকি করছে শুনে মনে মনে ভাবলো, আমি বাসার কাছে এসেছি মনে হয় এইজন্য এত ডাকছে। টুনটুনি দু’টো যেন বলছে- না না ভাই আমার বাসাটি ছিঁড়োনা! তালিবের মায়া হলো খুব। তারপর তার আব্বুর কাছে গিয়ে খেতের কাজ করলো। করতে করতে ভাবছে- এই বাসাটি কখনই ছেঁড়া যাবে না। কিন্তু আব্বু তো ক’দিন পরেই বেগুন ধরা শেষ হয়ে গেলে গাছগুলো উঠিয়ে নতুন ফসল বুনবে তখন কি হবে! বাসাটি তো আর থাকবে না। তো খুব চিন্তায় পড়ে গেলো তালিব! নানান কথা ভাবতে ভাবতে বেলা ডুবে এলে, ওরা হাতের কাজটুকু সেরে বাড়ি চলে গেলো।

রাতে শুয়ে পড়ে তালিব মনে মনে ভাবছে- যে করেই হোক এই বাসাটি রাখতেই হবে। ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুৃমিয়ে পড়লো। তারপর পাখি ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে তার আব্বুর সঙ্গে নামাজটা পড়ে সোজা চলে গেলো খেতে। কারন, আজ শুক্রবার, স্কুল বন্ধ। তার বাপের সাথে আজ একটু বেশিই কাজ করবে সে। খেতে এসেই কি আর মন দাঁড়ায়! টুনটুনির ওই বাসাটির কাছে চলে গেলো সোজা। কাছে কাছে যেতেই বাসার ভিতর থেকে একটি টুনটুনি উড়ে গেলো। সে ভাবলো, আমাকে দেখেই হয়তো এরকম করেছে ভয়ে, তাই বাসার কাছে আর যাওয়া যাবে না। ফিরে এসে আব্বুর সঙ্গে কাজ করতে আরম্ভ করলো। একপর্যায়ে তালিব বলে উঠলো- আব্বু, জানো আমাদের এই বেগুন খেতে একটি গাছে টুনটুনিতে বাসা বেঁধেছে! দু’টো ডিমও পেড়েছে।
আব্বু হাসিস্বরে বলে উটলো – তাই!

আরো কিছু একটা বলার আগেই তালিব বলে উঠলো- আব্বু, ওই বাসাটি না রেখে দিতে হবে।
দু’টো ডিম পেড়েছ, একদম ছোট ছোট, কী সুন্দর দেখতে! ক’দিন পরেই ডিম থেকে বাচ্চা হবে। বেগুন খেত শেষ হয়ে গেলেও আমি ওই গাছটি কাউকে কাটতে দেবো না। বাচ্চাগুলো যখন বড় হবে, মা’র সাথে ডালে ডালে উড়ে বেড়াবে তখন এই গাছটি আমিই কেটে ফেলবো আব্বু! বলো কাউকে এই গাছ কাটতে দেবে না!
ছেলেটির এই অদ্ভুত পদ্ধতি ও পাখির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে বলল- আচ্ছা বাবা, তা-ই হবে, কাউকে এগাছ কাটতে দেবো না। আব্বুর কাছ থেকে এমন সাড়া পেয়ে সে খুশিতে বাগবাগ! তারপর কিছুক্ষণ দুই বাপ-বেটা কাজ করারা পর সকালের খাওয়ার সময় হলে বাড়ি চলে গেলো দু’জন।

তালিবের এক বাল্যসাথী আছে খুব ভালো সে। কোনকিছু হলে তালিবকে না বলে থাকে না। সেদিন খালে খুব পুঁটিমাছ ধরা পড়ছিলো, সে তাড়াতাড়ি এসেই তালিবকে খবর দেয়। আর অমনি তালিব তার বন্ধু রায়ানকে নিয়ে মাছ মারতে চলে গেলো। অনেক মাছ মেরেছিলো দু’জন সেদিন। সে জন্য তালিবও তাকে এই পাখির বাসাটির কথা রায়ানকে বলতে খুব ইচ্ছে করছে। হাঁটতে হাঁটতে রায়ানদের বাড়িতে চলে গেলো। দেখে রায়ান খেতে বসেছে। তালিবকে অনেকটা জোর করে তার সঙ্গে খেতে বসালো রায়ান। খাওয়া শেষ হলে তালিব বললো- জানিস আজকে না আমি তোকে একটা জিনিস দেখাবো, বলতো কি?
রায়ান হেসে জবাব দেয় – না বললে আমি কি করে বলবো যে তুই আমারে কি জিনিস দেখাবি।

তালিব একটু কাছে গিয়ে কানের কাছে একটু আস্তে আস্তে বললো- আমাদের বেগুন খেতে না একটি টুনটুনির বাসা দেখেছি। তুই নানী বাড়ি বেড়াতে গেছিলি এজন্য বলতে পারিনি। কাল বাড়ি এসেছিস শুনে তাড়াতাড়ি এলাম।
রায়ান আনন্দমনে বললো- চল্ তাহলে এক্ষুনি গিয়ে দেখে আসি।
তালিবও বললো- চল্ তাহলে যাই।

তারা বাসাটির কাছে যেতেই ফুড়ুৎ করে টুনটুনি উড়ে গেলো বাসার ভিতর থেকে। তালিব সাবধানে রায়ানের কানের কাছে আস্তে আস্তে বলছে- শোন বাসার কাছে এখন যাওয়া যাবেনা। বলার পর একটু দূর থেকে বসাটি রায়ানকে আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো। আর বললো- আর কাউকে বলবি না এই বাসার কথা। রায়ানও তাতে রাজি হয়ে বলল- হুম। কিন্তু কাছে গিয়ে ডিম দুটো দেখতে পারলে ভালো লাগতো। তালিবেরও মন চাচ্ছে তাকে দেখায়। কিন্তু টুনটুনিরা যদি তাদের ভয়ে বাসাটি ছেঁড়ে দেয় এজন্য অন্য এক সময় দেখাবে বললো তালিব। কিন্তু রায়ানের মন মানছে না, সে এক্ষুনি দেখবে।

রায়ানের অনুরোধে ঘন্টাখানিক পর বাসাটির কাছে দুজন আস্তে আস্তে গেলো। দেখে ফুটফুটে দুটো বাচ্চা ফুটেছে। তাদের দেখে পিউপিউ করে মুখ হা করে ডাকছে। রায়ান বললো- তালিব, আমাদের দেখে আধার খেতে চাচ্ছে ওরা।
তালিব বললো- ঠিক বলেছিস বন্ধু। চল আমরা বেগুন খেত থেকে এক্ষুনি গিয়ে ফড়িং ধরে আনি।
রায়ান রাজি হয়ে গেলো। তারপর তারা দজন মিলে খুব আনন্দ সহকারে কিছু ফড়িং ধরে খাইয়ে আসলো ছানা দুটোকে। বাড়ি আসার সময় তালিব বলছে- আমরা তাহলে প্রতিদিন ছানা দুটোকে আধার খাওয়াবো, খোঁজ- খবর নেবো। তালিব বললো- ঠিক বলেছিস বন্ধু! কাল থেকে আমরা তা-ই করবো।

প্রতিদিন তারা দুজন মিলে বাসাটি সকাল বিকেল দেখতে যায়। এরকম করে প্রায় সপ্তাহখানিক দেখা শোনা করার পর তালিব নানি বাড়ি চলে গেলো বেড়াতে। যাওয়ার সময় রায়ানকে খুব জোর দিয়ে বলে গেলো ছানাদুটোকে দেখাশোনা করারা কথা। রায়ানও রাজি হয়ে তার দেখাশোনা করতে লাগলো। তারপরও মাঝেমাঝে ফোন করে তালিব রায়ানকে বলে- ঠিকমত খোঁজখবর নিচ্ছিস তো? রায়ান ছানাদুটোকে ভালোভাবে দেখাশোনা করারা কথা জানালে খুব খুশি তালিব। তার আব্বুকেও দুজন মিলে টুনটুনির বাচ্চা হওয়ার কথাটা বললে খুব খুশি হয় সে।

তাই আব্বুকেও নানিবাড়ি যাওয়ার সময় ছানাদুটোর খোঁজ-খবর নেওয়ার কথা বলে যায় তালিব। তাই তিনিও মাঝেমাঝে গিয়ে বাচ্চা দুটোকে দেখে আসে। খোঁজ-খবর নেয়।নানিবাড়ি বেড়িয়ে তালিবের ভালো আয়েশ মিটছে না। সারাক্ষণই ছানাদুটোর কথা মনে পড়ছে। তারা কি করছে না করছে। পাড়ার ছেলেমেয়ে কেউ দেখে ফেলেছে কি না। যদি দেখে ফেলে, হয়তো বাচ্চা দুটো নিয়ে যেতে পারে। বাচ্চাদের নিয়ে নানা বিপদের আশংকায় মামাবাড়ির স্বাদ ভেস্তে গেছে।

সপ্তাহখানিক পর তালিব বাড়ি এসে রায়ানকে সাথে নিয়ে চলে গলো বেগুন খেতে ছানাদুটোকে দেখতে। গিয়ে দেখতে পেলো, বাসায় কোন বাচ্চা নেই। রায়ান বাচ্চা দুটোকে পাশের আমবাগানের একটি গাছে দেখতে পেয়ে বলল- পাইছি! ওই যে বাচ্চা।
তালিবের মনে সুখের পরশ লেগে উঠলো আদরের বাচ্চা দুটোকে দেখে। কিন্তু মনটা একেবারেই মনমরা হয়ে গেলো। রায়ান দেখে বুঝতে পেরেছে, ততক্ষণে তারা সেই আমগাছটির পিছনে এসে দাঁড়ালো। প্রাণভরে উপভোগ করছে পাখির মুক্তগান। আর টপটপ করে তালিবে চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে পানি। রায়ান কাঁদাকাঁদা কন্ঠে বললো- বন্ধু, কাঁদার কিছু নেই, এটাতো আনন্দের! তোর ব্যাবস্থাপনায় আজ ছানাদুটোকে নিয়ে পাখিরা মুক্ত আকাশ খুঁজে পেলো। এটাই বড় স্বার্থকতা, বড় সাফল্য, বড় আনন্দ!


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!