লেখক – অপু সুলতান
১। “তোমাকে ভালোবেসে আজ মনে হচ্ছে আমার সমস্ত ভালোবাসা সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলেছি। কী ছিল না আমার? রূপ-যৌবন, অর্থবিত্ত- কোনটা? আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছো তুমি। এখন আমার কিছু নেই। আমি নিঃস্ব। আমি এখন নি’কো’টিনের বি’ষা’ক্ত ধোঁয়ায় বুঁদ হয়ে থাকি সারাক্ষণ। ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝাপসা পৃথিবীই ভালো লাগে আমার। জানিনা এই গন্তব্যের শেষ কোথায়।
আমিতো এমন জীবন চাইনি কখনও। আমি শুধু তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম এই চেনা শহরের জনারণ্য থেকে নির্জন কোনো এক গ্রামে। যেখানে তোমার আমার মাঝে কোনো বাঁধা থাকবেনা।” চিৎকার করে বলছিল অরুনিমা। ঘাম আর চোখের জলে একাকার হয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সে।
এমন সময় দরজায় সজোরে কড়া নড়ে। -অরু! অরু! হঠাৎ সম্বিত ফিরে পায় অরুনিমা। অন্ধকারে হাতড়ে জগ থেকে জল ঢেলে ডগডগ করে গিলতে থাকে। কিছুটা স্থির হয়। তারপর উত্তর দেয়।
-কিছু হয়নি, মা। -তাহলে চেঁচামেচি করছিস কেন? -স্বপ্ন দেখছিলাম। এরকম দুঃস্বপ্ন প্রায়শই দেখে অরুনিমা। কয়েকদিন হলো অরুনিমার মা-বাবা গ্রামে নিজেদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। আর অরুনিমা বেশ কয়েক বছর যাবত গ্রামেই থাকছে।
২। অরুনিমা। লম্বামতো দোহারা শরীরের গড়ন। বয়স ত্রিশের কোঠা পেরিয়ে চল্লিশ ধরধর। জোড়া ভুরু যুগলে টানা চোখ- হরিনীর মায়া লেগে আছে যার মুখ জুড়ে। গায়ের রঙ ফর্সা। রাস্তায় বের হলে এখনও শত চোখ তার দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক দৃষ্টিতে। এই দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। আদৌ ছিল কিনা তা কেউ জানে না। তার বাবার গড়া মফস্বলের বাচ্চাদের একটা স্কুলে পড়ায় সে। বাড়ি থেকে সোজা হেটে যায়- মাথা নিচু করে। রাস্তায় পরিচিত কেউ পাশ দিয়ে গেলেও দৃষ্টিগোচর হয়না তার।
শীত বাদে বাকী সব ঋতুতেই ছাতা মাথায় দিয়ে ধীর পায়ে চলে হেঁটে চলে সে। তার এই রকম নির্ঝঞ্ঝাট চলাফেরার কয়েকটি কারণ রয়েছে। স্বভাবগতভাবেই সে কিছুটা চুপচাপ ও শান্ত গোছের। তাছাড়া গ্রামে সে একা থাকে এবং একটা সময় ট্রমায় চলে গিয়েছিল- সেই অতীত নিয়ে কেউ কোনো কথা বলুক তা সে শুনতে চায় না। দ্বিতীয়ত কেন সে বিয়ে করেনি এবং এখনো করছে না কেন, বিয়ের বয়সতো শেষ, মানুষজনের ইত্যাদি বহুরকম প্রশ্ন এড়ানো। হয়তো কোনো রাজপুত্রও তার নজর কাড়েনি কোনদিন, তার শারীরিক সমস্যা আছে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সে আর বিয়ে করেনি- এরকম অনেক কথা গ্রামবাসীদের বলতে শোনা যায়।
৩। ঠিক একযুগ আগের কথা। সেদিন সোমবার দিবাগত রাত। অনেক চেষ্টা করেও দুচোখের পাতা এক করতে পারছে না অরুনিমা। ব্যাগ আর কাপড় চোপড় আগেই গুছানো হয়ে গেছে। রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সুনসান নীরবতা। ঘড়ির কাটার টিকটক শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কেন জানি আজকের রাতটাকে একটু বেশিই দীর্ঘ ও নীরব মনে হচ্ছে। সামান্য নড়াচড়াতেই পরনের কাপড়ের খচমচ শব্দও কানে এসে জোরে জোরে বাজছে। বিছানা থেকে উঠে সন্তর্পণে আলমারিটা খুলে অরুনিমা। গয়নার বাক্স থেকে দু’হাতে যা আসে তা নিয়ে ব্যাগে ঢুকায় সে। এবার চাবি দিয়ে অন্য একটি ড্রয়ার খুলে- বেশ কয়েকটা টাকার বান্ডিলও ব্যাগে ঢুকায়। গয়নার বাক্স কোথায় থাকে তা-সে আগে থেকেই জানতো। কিন্তু জটিলতা বাঁধে টাকার সন্ধান করতে গিয়ে।
ব্যবসায়ী বাবা। প্রতিদিন অনেক টাকা ব্যাংকের পাশাপাশি নগদেও লেনদেন করে। এর জন্য বাবাকে অনুসরণ করতে হয়েছে টানা কয়েকদিন ধরে। বাবা চাবি রাখে তার বিছানার নিচে- যার দরুণ কাজটা একটু কঠিনই ছিল। তা সত্বেও ঝুঁকিটা নিতেই হলো তাকে- কারণ এই সময় থাকা-খাওয়া, বাসাভাড়া ও যাতায়াত খরচবাবদ অনেক টাকার দরকার হবে। ভাবনা মতো কাজটাও সে যথাযথ ভাবে করতে পেরেছে।
৪। সকাল সাতটা। বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের সামনে দাড়িয়ে আছে অরুনিমা। হাসনাতেরও ঠিক একই সময় এখানে থাকার কথা। শপিংমল বন্ধ। বাবারও তাড়া নেই। বাসার কেউ আজ ঘুম থেকে এগারোটার আগে উঠার কথা না। এই সুযোগে অরুনিমা কায়দা করে বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। ঢাকা থেকে প্রথমে কক্সবাজার গিয়ে একটি হোটেলে উঠবে দু’জন। এরপর পরবর্তী গন্তব্য ও করণীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা হবে। এখনো হাসনাত আসেনি।
এদিকে প্রায় আটটা বেজে গেছে। সে অরুনিমাকে ফোন করে জানিয়েছে যে, তার একটু সমস্যা হচ্ছে- আসতে দেরি হবে। আসলে হাসনাতও সকাল থেকেই এসে বসে আছে। একটু দূরে- রাস্তার বিপরীত পাশে। যেখান থেকে তাকে দেখা যায় না। হাসনাত একটু পর পর অরুনিমাকে দূর থেকে দেখছে। সারারাত একটুও ঘুমায়নি হাসনাত। ঘেমে-নেয়ে একাকার। হাত দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছে ছিঁড়তে একবার সরু গলিটার ভিতরে যাচ্ছে তো আরেকবার সামনে আসছে। কিভাবে সে অরুনিমাকে বিয়ের কথা না করবে- ভেবে পাচ্ছে না।
হাসনাতের দিকে তার পরিবার তাকিয়ে আছে। একটা কিছু করে সংসারের হাল ধরতে হবে। ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে কোনো রকম দিন গুজরান দিচ্ছেন মা। বাবার ডায়াবেটিসটা মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। কিডনির সমস্যাটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে- মাসে তিন চার বার ডায়ালাইসিস করতে হয়। হাসনাত এখন বিবেকের কাঠগড়ায় দাড়িয়েছে। বিবেক তাকে সাফ সাফ না বলে দিয়েছে- “না, হাসনাত তুমি এটা করতে পারোনা।” হাসনাত ফোনটা হাতে নিয়ে বারবার অরুনিমাকে কল দিয়ে রিং হওয়ার আগেই কেটে দিচ্ছে। এদিকে অরুনিমাও তাকে ফোন দিচ্ছে।
হাসনাত এবার সাহস করে অরুনিমার ফোনটা রিসিভ করলো- “হাসনাত, তুমি কোথায়? আমাকে সকাল থেকে এখানে দাড় করিয়ে রেখেছো! তুমি সত্যি করে বলতো কী চাও?” হাসনাত দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল- “অরু আমি এটা পারবো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও।” অরুনিমা ফোনটা রেখে মাটিতে বসে পড়লো। অনেকক্ষণ নির্বিকার দৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে রইলো। দিনের পর দিন যে চারা গাছটাকে ভালোবাসা আর পরম মমতায় মহীরুহে পরিণত করেছে সে গাছটা একটা ঝাপটায় নিমিষেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
একটা অসম্ভব যন্ত্রণা বুকের ভিতরটা খামচে ধরেছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা কেউ অবিরাম ছুরিকাঘাতে ছিন্নভিন্ন করছে। হাসনাতও চোখের জলে একাকার হয়ে দিকবিদিকশুন্য দেখলো। অরুনিমা উঠে দাড়ালো। তল্পিতল্পাসহ কারওয়ান বাজারের প্রজাপতি গুহা পার হয়ে সোজা চলে যায় রেললাইনে। যদি কিছু একটা করে ফেলে এই ভেবে হাসনাতও অরুনিমার পিছু নেয়।
৫। একের পর এক ট্রেন সাঁই-সাঁই করে চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। অরুনিমা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ছে তার। শৈশবের দুরন্তপনার কথা। সফেদ দাড়িসমতে দাদার আদুরে মুখের কথা। দাদীর পান খেয়ে লাল করা টুকটুকে ঠোঁটের কথা। মায়ের স্নেহমাখা হাসির কথা। বাবার সীমাহীন ভালোবাসার কথা। মৃত্যুর আগে সব মানুষই তার প্রিয়জনদের কাছে পেতে মরিয়া হয়ে উঠে। হঠাৎই তার বাবা যেন তার কানের কাছে এসে বলে উঠলেন – “না মা, তুই এটা করিস না। আমি তোকে সারাটা জীবন আগলে রেখেছি- বাকী জীবনটাও আগলে রাখবো তোকে।” বারবার ব্যর্থ হচ্ছে অরুনিমা।
যতবারই রেল লাইনে পা রাখতে গেছে ততোবারই প্রিয় মুখগুলো তার সামনে এসে দাড়িয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি দেখে হাসনাতও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। পিছন থেকে অরুনিমার হাত টেনে ধরে বলে উঠলো “অরু তুমি যদি আমাকে সত্যি ভালোবাস তাহলে আ’ত্ম’হত্যা করতে পারো না। ভালোবাসা কোনো পাপ নয়- আ’ত্ম’হ’ত্যা ম’হাপা’প। আমি তোমাকে নিয়তির অমোঘ বিচারে বি’স’র্জ’ন দিলাম। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি একথা চন্দ্র-সূর্যের মতো সত্য।” অরুনিমা হেঁচকা টানে হাসনাতের হাত ছাড়িয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়ে।