ফুলপরীদের দেশে || মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেন। পড়ন্ত বিকেল, বাগানের পরিচর্যায় তানিশা ব্যস্ত। সাপ্তাহের প্রায় সব ক’টা দিনেই তানিসা তার বাগানের ফুল গাছ গুলোয় পানি দিতে চেষ্টা করে। পানি দেওয়ার সময় নরম সবুজ পাতাগুলো যেন মিটমিটিয়ে হাসে, তানিশার আনন্দ হয় খুব! মনে একটা সতেজতার অনুভূতি হয় ওর!
বাগানের ফুলগুলো তার ভীষণ প্রিয়। সবচেয়ে ভালো লাগে সাদা রঙের ফুলগুলো। সাদা রঙের বিভিন্ন ফুল- হাসনাহেনা, বেলী, গন্ধরাজ, কামিনী, শিউলি বাগানে যেন হাসছে। আরও রয়েছে বাহারি রঙের গোলাপ সহ বেশ কিছু ফুলের গাছ।
বাগানের ফুলগুলি যেমন সুন্দর, তানিশাও তেমন সুন্দর। হাসিতে তার মুক্তো ঝরে।
তানিশা এবার ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। নিয়মিত স্কুলে যায়, বাবা-মা র কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ, সে কখনো মিথ্যা কথা বলে না। ছোটদের স্নেহ করে,বড়দের শ্রদ্ধা করে। কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করে না, রাগারাগি করেনা।সহপাঠীদের সাথেও তার খুব সখ্যতা। এজন্য তানিশা সবার কাছে খুব প্রিয় একটি নাম, সবাই তাকে ভালোবাসে।
অবসর পেলে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ছড়া,কবিতা, গল্পের বই পড়ে। বিভিন্ন শিশুতোষ ম্যাগাজিন নিয়মিত পড়ে। ছাত্রী হিসেবেও সে খুবই ভালো। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল।
একদিন তাদের স্কুলে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্কুল পরিদর্শনে এসে তানিশাদের ক্লাসে প্রবেশকরে বলল,বলতো ঘড়ির কাঁটাগুলো সবগুলো কখন একত্রিত হয়? প্রশ্ন শুনে সবাই খুব চিন্তায় পড়লেও,তানিশার সপ্রতিভ উত্তর – স্যার দিন ও রাতের বারোটার সময় সবগুলো কাঁটা একত্রিত হয়।
তানিশাকে ধন্যবাদ দিয়ে শিক্ষা অফিসার একটি কলম উপহার দিল। তানিশা শুধু এসব গুণেই গুণান্বিতা নয়, তাঁর মনটাও খুব ভালো। কারও দুঃখ-কষ্ট দেখলে তাঁর মনটা কাঁদে।
গত ইদুল ফিতরে তার সহপাঠী আফিফাকে একটি নতুন জামা কিনে দিয়েছে।আফিফার বয়স যখন ৫ বৎসর তখন তার বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়। এর পর আফিফার মা অন্যের বাসায় কাজ করে কোনরকমে সংসার চালায়। তানিশা তার বাবাকে বলে, প্রতি বছর ইদে তো তুমি আমাকে দুটো নতুন জামা কিনে দাও।এবার আমি একটি জামা কিনব,অন্যটি আমি আমার সহপাঠী আফিফার জন্য কিনব।
বাবা তানিশার কথা শুনে খুব খুশি হয়। তানিশার ফুলের বাগানটি তাঁর পড়ার রুমের পাশেই। তানিশা জানালা দিয়ে ফুলের উপর নানা রঙের প্রজাপতির উড়ে চলা দেখে। ফুলগুলো যখন মৃদু হাওয়ায় দোলে তার যে তখন কী আনন্দ! তানিশা যেন ফুলের ভাষা বুঝে,ফুল কি বলতে চাইছে।
কেউ ফুল ছিড়লে তাঁর চাঁদের মতো মায়াবী মুখটা দুঃখে মলিন হয়ে যায়। তানিশা ৫ম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ” ঘাসফুল” কবিতায় পড়েছে ফুলেদের মিনতি- ফুল ছিঁড়ে পায়ের নিচে পিষে ফেলে মানুষ যেন তাদের কষ্ট না দেয়।তানিশা মনে করে ফুল ছেঁড়ার অর্থ ফুলকে মেরে ফেলা, গাছের যেমন প্রাণ আছে, ফুলেরও তেমনি প্রাণ আছে।
একদিন তানিশা স্কুল শেষ করে বাড়ি ফিরছে, হঠাৎ দেখে একটা ফুলপরী তার সামনে। ফুলপরীর মুখ দেখে তানিশা বুঝতে পারে, তার মন খুব খারাপ। ফুলপরী এসে তানিশাকে বলল, তোমাকে আমাদের ফুলপরীদের দেশে যেতে হবে, তোমার ভীষণ প্রয়োজন।তানিশা বলল, আচ্ছা যাবো। তার আগে বল,তোমার মনটা এত খারাপ কেন? কি হয়েছে তোমার?
যেতে যেতে সব বলব তোমায়, তুমি আমার ডানায় উঠে বস, বলল ফুলপরি,।
তানিশা ফুলপরীর ডানায় উঠে বসল। তানিশাকে নিয়ে ফুলপরী ছুটে চলল ফুলপরীদের দেশে। ফুলপরী বলল, জানো তানিশা আমাদের রাজ্যটা ছিল খুব সুখের। ফুলে ফুলে, পাখির গানে মুখরিত ছিল আমাদের রাজ্য।হঠাৎ একদিন এক দুষ্ট দৈত্য এসে আমাদের বাগানের সব ফুল ছিঁড়ে ফেলল।আমাদের রাণী এসব দেখে যেই না তাকে বন্দীর নির্দেশ দিল,ঠিক তখনি দৈত্য আরও রেগে গিয়ে তার যাদু দিয়ে আমাদের রাণী মাকে পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিল।
যাবার সময় বলে গেল, স্কুল পড়ুয়া তানিশা নামের কোন মেয়েকে যদি খুঁজে পাও- যে কিনা ফুলকে খুব ভালোবাসে, সত্য কথা বলে। সে যদি রাণী মাকে স্পর্শ করে তবেই কেবলমাত্র তোমাদের রাণীমা প্রাণ ফিরে পাবে। এটুকু বলতে বলতেই তানিশাকে নিয়ে ফুলপরী তাদের রাজ্যে উপস্থিত হলো। সবাই খুব খুশি তানিশাকে দেখে। এ দিনটার জন্য তারা অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিল। তানিশা নেমেই রাণীমাকে স্পর্শ করল। সাথে সাথে রাণীমা জীবন ফিরে পেল।
সারা রাজ্যে তখন আনন্দের বন্যা। তানিশাকে নিয়ে তারা সারা রাজ্যের সব ফুলের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখালো।মিষ্টি নরম রোদে বাহারী সব ফুল দেখে তানিশার চোখে অপার বিস্ময়! তানিশার আনন্দ যেন আর ধরে না! চোখে মুখে তার মুগ্ধতার ছাপ।
রাণীমা বলল, দুষ্ট দৈত্য আমাকে প্রায় ১৮ মাস ধরে এমন পাথরের মূর্তি বানিয়ে রেখেছে। সে ইচ্ছে করেই এরকম শর্ত দিয়েছিল যে, করোনার প্রকোপও কমবে না,স্কুলও খুলবে না।
ফুলপরী বলল, আমরা তোমাদের প্রত্যেকটি স্কুলে নজর রেখেছিলাম, তোমাকে খোঁজার জন্য। আমাকে মুগ্ধ করেছে তোমাদের দেশের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। যেন আনন্দের এক রঙিন ফুল তোমাদের দেশের প্রত্যেকটি স্কুল। রাণী মা বলল,তানিশা তুমি কি উপহার চাও? তানিশা মৃদু হেসে বলল,আমার কিছু চাওয়ার নেই। আমি আপনার এত বড় উপকারে আসতে পেরেছি, এতেই আমি ধন্য। আমার জন্য শুধু দোয়া করবেন,আমি যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারি। মানুষের উপকারে জীবনটা বিলিয়ে দিতে পারি।
রাণীমা তানিশার কথা শুনে তাঁর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে বুকে টেনে নিলেন। রাণীমার দোয়া নিয়ে ফুলপরী আবার তার ডানায় তানিশাকে উঠিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডানা মেলল। লেখক- নান্দিনা, জামালপুর।